
জুমাস ডেস্ক: অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে শেষ হলো কোপা আমেরিকার ফাইনাল। কোপা আমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হলো। ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের গোলে কলম্বিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার কোপা আমেরিকা জিতে নিল আর্জেন্টিনা।

গত দুই বছর ধরে ২৮ ম্যাচ অপরাজিত থাকা কলম্বিয়া তাদের ঘাম ছুটিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই আসরে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা লাউতারো মার্টিনেজের একমাত্র গোল গড়ে দিয়েছে পার্থক্য। মায়ামি গার্ডেন্সের হার্ড রক স্টেডিয়ামে অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে তার লক্ষ্যভেদী শটে ১-০ গোলে জিতে চ্যাম্পিয়ন হলো আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসিকে খেলার এক পর্যায়ে পায়ের গোড়ালিতে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যেতে হলে। মাঠ ছাড়তে ছাড়তে এবং ডাগআউটে বসেও কেঁদেছেন মেসি।

টেলিভিশনের পর্দায় মেসির কান্নার দৃশ্য দেখতে দেখতেই ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষ হয়েছে গোলশূন্য অবস্থায়, ম্যাচ গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে।
অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচে লাওতারো মার্তিনেজের ১১২ মিনিটের গোলে কলম্বিয়াকে হারিয়ে ত্রিমুকুট জিতেছে আর্জেন্টিনা। মহাদেশীয় শিরোপা, বিশ্বকাপ, আবার মহাদেশীয় শিরোপা—স্পেনের পর এই ত্রিমুকুট জেতা দ্বিতীয় দল এখন আর্জেন্টিনা। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার পর ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনা জিতল ২০২৪ সালের কোপা আমেরিকা। স্পেন এই কীর্তি গড়েছিল ২০১০ বিশ্বকাপের আগে ও পরে ইউরোর শিরোপা জিতে। ইউরোর শিরোপা দুটি তারা জিতেছে ২০০৮ ও ২০১২ সালে।

ম্যাচ শুরুর আগেই বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় হার্ড রক স্টেডিয়ামের বাইরে। কলম্বিয়ান ও আর্জেন্টাইন ভক্তদের আবেগের ম্যাচটি দর্শক–বিশৃঙ্খলার কারণে প্রায় ১ ঘণ্টা ২২ মিনিট দেরিতে শুরু হয়। বিনা টিকিটে খেলা দেখতে আসা কিছু দর্শক নিরাপত্তার বেড়াজাল এগিয়ে মাঠে ঢোকার চেষ্টা করেন। সেটা সামলাতে সময় লাগায়ই ম্যাচ শুরু করতে এই দেরি।
দর্শক–বিশৃঙ্খলার কারণে প্রায় ১ ঘণ্টা ২২ মিনিট দেরিতে শুরু হওয়া আর্জেন্টিনা–কলম্বিয়া ফাইনালের নির্ধারিত ৯০ মিনিটেও ছিল নানা নাটকীয় ঘটনা। চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে গেছেন লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনার অধিনায়কের জায়গায় মাঠে নামা নিকো গঞ্জালেস বল জালে জড়ালেও অফসাইডের কারণে গোল বাতিল করেন রেফারি। নির্ধারিত ৯০ মিনিটে গোলশূন্য থাকা ম্যাচ গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে।
ম্যাচের শুরুর দ্বিতীয় মিনিটে আর্জেন্টিনা সুযোগ তৈরি করেছিল। বাঁ প্রান্ত থেকে গনসালো মন্তিয়েলের ক্রস বক্সের মধ্যে খুঁজে পায় জুলিয়ান আলভারেজকে। তার নেওয়া প্রথম শটে জোর ছিল না।
ফাঁকায় বল পেয়ে ষষ্ঠ মিনিটে লুইস দিয়াজ আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ ভেদ করেন। কাছের পোস্ট থেকে নিচু শট নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আর্জেন্টাইন কিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ সেভ করেন সহজে।
পরের মিনিটে জেমস রদ্রিগেজের চমৎকার বানিয়ে দেওয়া বলে জন করদোবা অ্যাক্রোবেটিক শট নেন, যা পোস্টের বাইরে আঘাত করে। ১৩ মিনিটে কর্নার থেকে জেমসের উড়িয়ে মারা বলে কার্লোস কুয়েস্তা লক্ষ্যে হেড করেছিলেন। এবারও মার্টিনেজ বেশ ভালোভাবে ধাক্কা সামলে নেন। তিন মিনিট পর আবারও জেমস পরীক্ষা নেন আর্জেন্টাইন কিপারকে।

আর্জেন্টিনা ২০ মিনিটে কলম্বিয়ার ডিফেন্সে আতঙ্ক ছড়ায়। অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার নিচু ক্রসে লিওনেল মেসি প্রথম শট নিলে তা ব্লক করেন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার। ডেভিনসন সানচেজের পাসে কলম্বিয়ার কেউ পায়ে বল নিতে পারেননি, সরাসরি মার্টিনেজের হাতে চলে যায় বল।
কলম্বিয়া গোলের পরিষ্কার সুযোগ পায় ৩৩ মিনিটে। বেশ দূর থেকে জেফারসন লারমা লক্ষ্যে শট নেন। গোলমুখের সামনে ভেসে আসা বল ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আঙুলের ছোঁয়ায় লক্ষ্যভ্রষ্ট করেন মার্টিনেজ।
কলম্বিয়া আর্জেন্টিনার চেয়ে ভালো সুযোগ তৈরি করলেও প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের কারণে জালের দেখা পায়নি।
দ্বিতীয়ার্ধে ৬৪তম মিনিটে গোড়ালির চোটে ব্যথায় মাটিতে পড়ে যান মেসি। দুই মিনিট পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠের বাইরে যান আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। তার বদলি হন নিকো গনসালেস।
৭৮ মিনিটে জেমসের ফ্রি কিক ক্রসে বল পান কার্লোস কুয়েতা। তার হেড লক্ষ্যে ছিল না।
৮৮ মিনিটে ডি মারিয়ার ক্রস থেকে নিকো গনসালেস গোলমুখের সামনে হেড করেন। আলভারেজকে শুধু বল ঠেলে দিলেই হতো, কিন্তু সময়মতো পা ছোঁয়াতে পারেননি।
ইনজুরি টাইমের প্রথম মিনিটে বক্সের মধ্যে ভালো অবস্থানে বল পেয়েছিলেন ডি মারিয়া। কিন্তু ভারসাম্য রাখতে না পেরে শট নিতে ব্যর্থ হন আর্জেন্টাইন প্লে মেকার। স্কোর গোলশূন্য থেকে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
প্রথম ৯০ মিনিটে আধিপত্য দেখানো কলম্বিয়া ছন্দ হারায় এক্সট্রা টাইমে। অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলায় প্রথম সুযোগ তৈরি করে আর্জেন্টিনা। ৯৫ মিনিটে রদ্রিগো ডি পল দৌড়ে বক্সে ঢোকেন। ব্যাকপোস্টে গনসালেসকে পেয়ে কাটব্যাক করেন। গনসালেসের দুর্বল শট সরাসরি ধরে ফেলেন ক্যামিলো ভার্গাস।
সাত মিনিট পর জায়গা খুঁজে নিয়ে জন আরিয়াস দূর থেকে শট নেন। তার শট ডিফ্লেক্টেড হয়ে মার্টিনেজের হাতে ধরা পড়ে।
দ্বিতীয়ার্ধে ১০৭ মিনিটে ডানদিক থেকে ডি মারিয়ার ভাসানো ক্রস গোলমুখের সামনে পেয়েও বলে পা ছোঁয়াতে পারেননি লাউতারো।
পরের মিনিটে ম্যাচ সেভিং ব্লক করেন লিসান্দ্রো মার্টিনেজ। উরাইব বক্সের মধ্যে বল পেয়ে যথেষ্ট সময় নিয়ে গোলে শট নিতে চেয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে ট্যাকল করে ব্লক করেন লিসান্দ্রো।

৯৭তম মিনিটে জুলিয়ান আলভারেজের বদলি মাঠে নামেন লাউতারো। পাঁচ মিনিট পর জিওভানি লু সেলসোর থ্রু বলে বক্সের মধ্যে ঢুকে গোলকিপার ভার্গাসের শরীরের ওপর দিয়ে কোনাকুনি শটে জাল কাঁপান তিনি। তার ২৯তম আন্তর্জাতিক গোলে ১১২ মিনিটে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। চলতি আসরে পঞ্চম গোল করে গোল্ডেন বুটও নিশ্চিত করে ফেলেন এই ফরোয়ার্ড।

১১৬ মিনিটে শেষবারের মতো আর্জেন্টিনার জার্সিতে মাঠ ছাড়েন অশ্রুসিক্ত ডি মারিয়া। খেলা শেষ হওয়ার ৩০ সেকেন্ড বাকি থাকতে বক্সের মধ্যে বোরহা পড়ে গেলে পেনাল্টি দেখার জন্য রেফারিকে জোরাজুরি করতে থাকেন কলম্বিয়ান খেলোয়াড়রা। তা আমলে নেননি ব্রাজিলের রেফারি রাফায়েল ক্লাউস। মার্টিনেজ গোল কিক নিতেই শেষ বাঁশি বাজান তিনি। আনন্দে মেতে ওঠেন আকাশী-নীল জার্সিধারীরা।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই আর্জেন্টিনার কাছে হারের পর থেকে অপরাজিত ছিল কলম্বিয়া, এবার একই দলের কাছে অজেয় মর্যাদা হারালো তারা। ওইবারও গোল করেছিলেন লাউতারো।
কলম্বিয়া জিতেছে ফেয়ার প্লে ট্রফি। গোল্ডেন বুট পেয়েছেন লাউতারো। আর কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপের পর এবারও গোল্ডেন গ্লাভ জিতলেন মার্টিনেজ।

দি মারিয়া মাঠ থেকে নেমে ডাগআউটে গিয়ে কান্নাভেজা চোখে জড়িয়ে ধরেন মেসিকে। মেসিও কাঁদলেন দি মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে। ১৬ বছরের সতীর্থকে বিদায় দেওয়ার কষ্টের সঙ্গে মেসির এবারের কান্নায় মিশে ছিল কিছুক্ষণ পরই কোপা আমেরিকার শিরোপা জিততে যাওয়ার আনন্দও।
মেসি–দি মারিয়ারা আনন্দ–বেদনার কান্নায় যখন মাখামাখি, মাঠে ছড়িয়ে পড়ে তুমুল উত্তেজনা। পিছিয়ে পড়া কলম্বিয়ার খেলোয়াড়েরা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলেন না সম্ভাব্য হার। একটা পর্যায়ে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা। রেফারি মধ্যস্থতায় থামে সে মারামারি।
এরপর মেসি–দি মারিয়াদের ইতিহাস, আর্জেন্টাইনদের আনন্দে মেতে ওঠা..!
